সাংবাদিক খালেদ মুহিউদ্দীনের বক্তব্যে নতুন বিতর্ক
বাংলাদেশের রাজনীতি এবং সাংবাদিকতার সংযোগ সবসময়ই বিতর্কিত। এবার সেই বিতর্কে নতুন মাত্রা যোগ করলেন নিউইয়র্কভিত্তিক সংবাদমাধ্যম ‘ঠিকানা’-এর সাংবাদিক ও সম্পাদক খালেদ মুহিউদ্দীন। সম্প্রতি একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের আলোচনায় তিনি বলেন—
“আশ্চর্য! আমি একটা মানুষকে কেন খুনি বলব?”
এই একটি বাক্যই এখন আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু। বিশেষত, তাঁর এই মন্তব্য এসেছে এমন এক সময়, যখন বাংলাদেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও বর্তমান রাজনৈতিক বিতর্কের মূল চরিত্র শেখ হাসিনাকে নিয়ে দেশের ভেতর-বাইরে তীব্র আলোচনা চলছে।
প্রশ্ন থেকে শুরু, বিতর্কে বিস্ফোরণ
২৮ অক্টোবর, মঙ্গলবার নিউইয়র্কের এক বিশ্ববিদ্যালয়ে আয়োজিত একটি মুক্ত আলোচনা সভায় উপস্থিত ছিলেন সাংবাদিক খালেদ মুহিউদ্দীন। অনুষ্ঠানের বিষয়বস্তু ছিল: “সাংবাদিকতার ভূমিকা ও দায়বদ্ধতা—বাংলাদেশ প্রসঙ্গে”।
একপর্যায়ে আলোচনায় উঠে আসে শেখ হাসিনাকে ইন্টারভিউ করার প্রসঙ্গ। শ্রোতাদের মধ্যে থেকে একজন প্রশ্ন করেন—
“যে মানুষ ১৫ হাজার শহীদের দায়ে অভিযুক্ত, যিনি অবৈধ নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় ছিলেন, আপনি তাকে কেন ইন্টারভিউ করতে চান?”
খালেদ মুহিউদ্দীন জবাবে বলেন—
“যে খুনি, তার বিচার করার দায়িত্ব আদালতের। আমি সাংবাদিক, বিচারক নই। আশ্চর্য! আমি একটা মানুষকে কেন খুনি বলব?”
তাঁর এই বক্তব্যেই শুরু হয় তুমুল বিতর্ক। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে মুহূর্তেই ভাইরাল হয়ে যায় ভিডিওর ওই অংশ। কেউ বলছেন, খালেদ মুহিউদ্দীন সাহসী— কারণ তিনি সাংবাদিকতার নীতির প্রতি অনুগত; আবার কেউ বলছেন, তিনি নাকি শেখ হাসিনাকে ‘নরমালাইজ’ করার চেষ্টা করছেন।

“আমি যদি না বলি, তাহলে কী হয়েছে?”
সেই আলোচনায় আরেকজন প্রশ্নকর্তা খালেদকে চ্যালেঞ্জ করে বলেন,
“আপনি তো নিজেই অবৈধ নির্বাচন, ১৫ হাজার শহীদ, মানবাধিকার লঙ্ঘনের কথা বললেন— তাহলে শেখ হাসিনাকে খুনি বলতে আপনার আপত্তি কোথায়?”
খালেদ মুহিউদ্দীন শান্ত স্বরে জবাব দেন—
“আমি একজন সাবেক প্রধানমন্ত্রীকে ইন্টারভিউ করতে চাই বলেছি। তাহলে কি পুরো ‘রেফারেন্স’ সহ বলতে হবে— ‘খুনি শেখ হাসিনা’? আমি যদি না বলি, তাতে কী হয়েছে? এতে কি আমি তাঁর দোসর হয়ে গেলাম?”
এই বক্তব্যের পর শ্রোতাদের একাংশ করতালি দেয়, অন্য অংশের প্রতিক্রিয়া ছিল দৃশ্যত কঠোর। কেউ কেউ বলেছিলেন— খালেদ সাংবাদিক হিসেবে নিরপেক্ষতার পক্ষে দাঁড়ালেও তাঁর অবস্থান রাজনৈতিকভাবে ‘সংবেদনশীল সময়ের’ তুলনায় অতিমাত্রায় নরম।
“হাসিনাকে ইন্টারভিউ দেওয়া মানে কি তাকে নরমালাইজ করা?”
বিতর্ক আরও তীব্র হয় যখন কেউ প্রশ্ন তোলেন, শেখ হাসিনাকে ইন্টারভিউ নেওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ মানে কি তাঁকে স্বাভাবিক করে দেখানো নয়?
খালেদ মুহিউদ্দীন তখন একধরনের খেদ প্রকাশ করে বলেন—
“আপনারা ভাবছেন, শেখ হাসিনার ইন্টারভিউ মানে তাঁকে নরমালাইজ করা? সাংবাদিকতা কখনোই ক্ষমতাকে নরমালাইজ করে না, বরং প্রশ্নের মুখে দাঁড় করায়। পাঁচ লাখ ইন্টারভিউও শেখ হাসিনাকে নরমালাইজ করতে পারবে না।”
তিনি যুক্তি দেন, সাংবাদিকতার প্রথম নীতি হচ্ছে পাবলিক ইন্টারেস্ট— অর্থাৎ জনগণের জানার অধিকার। তাঁর মতে, শেখ হাসিনার মতো একজন বিতর্কিত রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বকে প্রশ্নের মুখে দাঁড় করানোই আসলে সাংবাদিকতার দায়িত্ব।
সাংবাদিকতার নৈতিকতা বনাম রাজনৈতিক আবেগ
এই বিতর্ককে ঘিরে দেশে–বিদেশে সাংবাদিক ও বুদ্ধিজীবী মহলে নতুন করে আলোচনার জন্ম হয়েছে। অনেকেই বলছেন— খালেদের বক্তব্য আসলে সাংবাদিকতার নীতিবোধের জায়গা থেকে বলা, যেখানে সাংবাদিক বিচারকের ভূমিকায় নয়, বরং তথ্য অনুসন্ধানকারীর ভূমিকায় থাকেন।
অন্যদিকে, সমালোচকদের যুক্তি— বাংলাদেশের রাজনৈতিক বাস্তবতায় শেখ হাসিনা কেবল একজন সাবেক প্রধানমন্ত্রী নন; তিনি এক দমনমূলক সরকারের প্রতীক। তাঁর বিরুদ্ধে মানবাধিকার লঙ্ঘন, গুম-খুন, বিচারবহির্ভূত হত্যা, নির্বাচনী জালিয়াতির অভিযোগ রয়েছে। ফলে তাঁকে ইন্টারভিউ করার ঘোষণা দেওয়া মানে তাঁকে ‘মানবিক অবয়ব’ দেওয়ার ঝুঁকি তৈরি করা।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, এই বিতর্ক আসলে নৈতিক সাংবাদিকতা বনাম নৈতিক প্রতিরোধ—এই দুই ধারণার সংঘাত। কেউ মনে করছেন, সাংবাদিকের কাজ সত্যকে তুলে ধরা, যেই সত্যই হোক না কেন। আবার কেউ মনে করেন, কোনো কোনো সত্যকে প্ল্যাটফর্ম দেওয়াই অন্যায়ের অংশীদার হয়ে যাওয়া।
শেখ হাসিনা: বিতর্কের কেন্দ্র
সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে অভিযোগের তালিকা দীর্ঘ— বিরোধী দল দমন, গণমাধ্যম নিয়ন্ত্রণ, দুর্নীতি, মানবাধিকার লঙ্ঘন, এমনকি ২০১৮ সালের নির্বাচনে ‘ভোট ডাকাতি’র অভিযোগ। সাম্প্রতিক রাজনৈতিক উত্থান-পতনের পর তাঁকে ঘিরে আন্তর্জাতিক পর্যায়েও নানা তদন্ত চলছে।
এই প্রেক্ষাপটে খালেদ মুহিউদ্দীনের মন্তব্য নতুন মাত্রা যোগ করেছে। তাঁর বক্তব্য যেমন একটি প্রশ্ন তোলে— সাংবাদিক কি কখনো কাউকে “খুনি” বলতে পারেন?— তেমনি আরেকটি বড় প্রশ্নও উত্থাপন করে— একজন অভিযুক্ত রাজনৈতিক নেতাকে ইন্টারভিউ করার মধ্য দিয়ে সাংবাদিক কি নৈতিক সীমা অতিক্রম করছেন?
“খুনি” শব্দের দায়বদ্ধতা
আইনজীবী ও মানবাধিকারকর্মীরা বলছেন, “খুনি” শব্দটি কেবল আদালতের রায়ে ব্যবহৃত হওয়া উচিত। সাংবাদিক বা সাধারণ মানুষ কাউকে এভাবে অভিহিত করলে তা নৈতিক ও আইনি প্রশ্ন তোলে।
খালেদ মুহিউদ্দীনও ঠিক এই জায়গাতেই অবস্থান নিয়েছেন। তাঁর মতে, সাংবাদিকের কাজ বিচার নয়— তথ্য তুলে ধরা। একজন অপরাধীর অভিযোগ প্রমাণ না হলে, সাংবাদিকের পক্ষে তাকে ‘খুনি’ বলা আইনত ও নৈতিকভাবে সঠিক নয়।
তবে মানবাধিকার কর্মীরা পাল্টা প্রশ্ন তুলেছেন— “যখন রাষ্ট্রই আদালতকে নিয়ন্ত্রণ করে, তখন কারা বিচার করবে?” এই প্রশ্নই বিতর্ককে আরও জটিল করে তুলেছে।
সাংবাদিকতা ও সাহসের সংজ্ঞা
খালেদ মুহিউদ্দীন বাংলাদেশে দীর্ঘদিন সাংবাদিকতা করেছেন। এখন নিউইয়র্কে থেকে প্রবাসী গণমাধ্যম ‘ঠিকানা’ পরিচালনা করছেন। তাঁর সমর্থকদের দাবি, তিনি সব সময়ই সাংবাদিকতার স্বাধীনতায় বিশ্বাসী।
এই ঘটনার পর সামাজিক মাধ্যমে অনেকে লিখেছেন,
“খালেদ মুহিউদ্দীন শেখ হাসিনার মুখে সত্য শুনতে চান— তাঁকে নরমালাইজ করতে নয়, বরং প্রকাশ্যে জবাবদিহিতার মুখে দাঁড় করাতে।”
অন্যদিকে সমালোচকদের যুক্তি—
“যে ব্যক্তি হাজারো গুমের দায়ে অভিযুক্ত, তার সঙ্গে ইন্টারভিউ মানে ভিকটিমদের প্রতি অসম্মান।”
দুই পক্ষের এই তর্ক আবারও প্রমাণ করছে, বাংলাদেশে সাংবাদিকতা এখন কেবল তথ্যের কাজ নয়; এটি এক রাজনৈতিক অবস্থানও বটে।
প্রবাসী সাংবাদিকতা ও স্বাধীন কণ্ঠের চ্যালেঞ্জ
বাংলাদেশে গণমাধ্যমের ওপর সরকারের নিয়ন্ত্রণ, সম্পাদকদের গ্রেপ্তার, বিজ্ঞাপন বন্ধ, এবং ডিজিটাল সিকিউরিটি আইনের ভয়াবহ প্রভাবের কারণে অনেক সাংবাদিক এখন প্রবাসে কাজ করছেন। নিউইয়র্ক, লন্ডন, টরন্টো— এসব শহর হয়ে উঠেছে বাংলাদেশের স্বাধীন সাংবাদিকতার নতুন কেন্দ্র।
কিন্তু প্রবাসেও তারা মুক্ত নন। রাজনৈতিক মেরুকরণ সেখানে পৌঁছে গেছে। কেউ বিএনপি–ঘেঁষা, কেউ আওয়ামীপন্থী— এমন অভিযোগ প্রায়ই ওঠে। এই বাস্তবতায় খালেদ মুহিউদ্দীনের মতো সাংবাদিকরা ভারসাম্য রক্ষা করতে গিয়ে আরও কঠিন অবস্থায় পড়েন।
“সত্যের মুখোমুখি করতে চাই”
বিতর্কের পর এক ফেসবুক পোস্টে খালেদ মুহিউদ্দীন লিখেছেন,
“আমি শেখ হাসিনাকে ইন্টারভিউ করতে চাই, কারণ জনগণ জানতে চায়— তিনি কী ভাবছেন, কীভাবে নিজের কর্মকাণ্ডকে যুক্তি দিচ্ছেন। সাংবাদিকের কাজ হলো অপরাধীকে নয়, তার অপরাধকে প্রকাশ করা। আমি কাউকে নরমালাইজ করতে চাই না; আমি সত্যকে মুখোমুখি করতে চাই।”
তাঁর এই ব্যাখ্যা আংশিকভাবে বিতর্ক কমালেও পুরোপুরি থামাতে পারেনি। বরং অনেকেই বলছেন— তিনি হয়তো সৎ উদ্দেশ্যে বলেছেন, কিন্তু সময় ও প্রেক্ষাপট তাঁর বিরুদ্ধে গেছে।
সাংবাদিকতা: পেশা না প্রতিরোধ?
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে সাংবাদিকতার নৈতিক অবস্থান এখন এক কঠিন প্রশ্নের সামনে দাঁড়িয়ে। সরকারবিরোধী সাংবাদিকতা মানে অনেক সময়ই ‘প্রতিরোধের অংশ’ হয়ে যাওয়া। আবার সরকারের সমালোচনায় সংযম মানেই অভিযুক্ত হওয়া “দোসর” হিসেবে।
খালেদ মুহিউদ্দীনের ঘটনাটি এই জটিল বাস্তবতাকে নগ্নভাবে সামনে নিয়ে এসেছে।
সাংবাদিকতার সংজ্ঞা অনুযায়ী, সাংবাদিক সবসময় তথ্যের পক্ষে, ব্যক্তি নয়। কিন্তু যখন ব্যক্তি নিজেই তথ্যকে বিকৃত করেন, তখন সাংবাদিকের দায়িত্ব হয়ে দাঁড়ায় সত্যকে সামনে আনা— এমনকি সেটি যদি বিপজ্জনকও হয়।
শেষ কথা: বিতর্কের চেয়েও বড় প্রশ্ন
খালেদ মুহিউদ্দীনের বক্তব্য হয়তো বিতর্কিত, কিন্তু তাঁর প্রশ্নটি আরও বড়—
“সাংবাদিক কি কখনো কাউকে খুনি বলতে পারেন?”
এই প্রশ্নই আমাদের নতুনভাবে ভাবতে বাধ্য করছে— সাংবাদিকতা আসলে কাকে সেবা করে? রাষ্ট্রকে, জনগণকে, না সত্যকে?
যদি সাংবাদিকতা সত্যের জন্য হয়, তাহলে শেখ হাসিনার মতো বিতর্কিত নেতাকেও প্রশ্নের মুখোমুখি করা প্রয়োজন। কিন্তু সেই প্রশ্ন যেন হয়ে না ওঠে প্রচারণার অংশ, বরং জবাবদিহিতার এক মঞ্চ।
আজকের এই তর্কের ভেতর দিয়েই হয়তো আমরা বুঝতে পারব— গণতন্ত্র কেবল ভোটে নয়, কথায়ও টিকে থাকে।
আর সেই কথাকে প্রশ্নে পরিণত করার দায়িত্ব সাংবাদিকেরই।
