— বাংলাদেশের ‘অগ্রগতির’ গল্পের আড়ালে যে বাস্তবতা
গত এক দশক ধরে বাংলাদেশের রাজনীতিতে “উন্নয়ন” যেন হয়ে উঠেছে একধরনের জনপ্রিয় স্লোগান, এক রাজনৈতিক ব্র্যান্ড। সরকার বলছে, আমরা “মেগা প্রজেক্টের দেশ”— পদ্মা সেতু, মেট্রোরেল, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে, কর্ণফুলি টানেল— এসবই যেন উন্নয়নের নতুন প্রতীক। কিন্তু এই চোখধাঁধানো গল্পের ভেতরে লুকিয়ে আছে অন্য এক বাস্তবতা— অসম উন্নয়ন, অজস্র দুর্নীতি, আর জনগণের বঞ্চনা।

মেগা প্রকল্প: উন্নয়নের মুখোশ নাকি ফাঁদ?
বাংলাদেশের উন্নয়ন বয়ানের সবচেয়ে বড় ভিত্তি হয়ে উঠেছে এই “মেগা প্রকল্প”গুলো। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে— এই প্রকল্পগুলো আসলেই কার জন্য? জনগণের কল্যাণের জন্য, নাকি রাজনৈতিক শক্তির টিকে থাকার হাতিয়ার?
অর্থনীতিবিদদের মতে, এসব প্রকল্পের বেশিরভাগই অতি ব্যয়বহুল এবং ফলপ্রসূতার তুলনায় অনেক বেশি ঋণনির্ভর। ১৮ লাখ কোটি টাকারও বেশি ঋণের বোঝা এখন দেশের ঘাড়ে। অথচ বাস্তবে সাধারণ মানুষ সেই উন্নয়নের সুফল পাচ্ছে না। বরং, নানা নির্মাণ ত্রুটি ও দুর্নীতির কারণে মেগা প্রকল্পের কিছু অংশ এখন পরিণত হয়েছে দুর্ঘটনার ঝুঁকিতে— মেট্রোরেলের যন্ত্রাংশ পড়ে পথচারীর মৃত্যু কিংবা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের দুর্ঘটনা— এসবই তার প্রমাণ।
উন্নয়নের নাম করে লুটপাটের রাজনীতি
এই মেগা প্রকল্পগুলো ঘিরে যে বিশাল অর্থনৈতিক চক্র গড়ে উঠেছে, তার ভেতরে আছে ক্ষমতাধরদের একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণ। ঠিকাদার, আমলা, রাজনীতিক— সবারই ভাগ থাকে এই উন্নয়নের কেক থেকে। এই প্রক্রিয়াকে সমাজবিজ্ঞানীরা বলছেন “শোষণমূলক উন্নয়ন”।
নয়া মার্ক্সবাদী তাত্ত্বিক আন্দ্রে গুন্ডার ফ্রাংকের “development of underdevelopment” বা “অনুন্নয়নের উন্নয়ন” তত্ত্ব দিয়ে এই পরিস্থিতিকে ব্যাখ্যা করা যায়। তাঁর মতে, অনেক দেশেই উন্নয়নের নামে এমন প্রক্রিয়া চলে যেখানে সামান্য উন্নতির আড়ালে বহুগুণে বাড়ে বৈষম্য ও অনুন্নয়ন— যা আজকের বাংলাদেশের বেলায়ও সত্য।
উন্নয়ন কার জন্য?
মেগা প্রকল্পের এই গল্পে যাঁরা লাভবান হচ্ছেন, তাঁরা দেশের এক ক্ষুদ্র সুবিধাভোগী শ্রেণি। রাজধানীর গ্লাস টাওয়ারে কিংবা বিদেশের সিটি ব্যাংক একাউন্টে তাঁদের উন্নয়নের প্রতিফলন স্পষ্ট, কিন্তু গ্রামের মানুষ বা নিম্ন আয়ের শহুরে শ্রমিকের জীবনে সেই উন্নয়ন পৌঁছায়নি।
গ্রামীণ চিকিৎসা, শিক্ষা, কৃষি বা ক্ষুদ্র উদ্যোগের মতো খাতে পর্যাপ্ত বিনিয়োগের বদলে রাষ্ট্র ব্যস্ত থেকেছে বিলিয়ন ডলারের ইট-পাথরের প্রকল্পে। অথচ টেকসই উন্নয়ন বলতে বোঝায় এমন একটি কাঠামো, যেখানে উন্নয়নের সুফল জনগণের জীবনে বাস্তব পরিবর্তন আনে— শুধু শহরের সেতু নয়, মানুষের মাথার ওপর ছাদ তোলে।
রাজনীতি ও উন্নয়নের মিথস্ক্রিয়া
বাংলাদেশের রাজনীতিতে উন্নয়ন এখন একধরনের “ব্র্যান্ড পলিটিক্স”। দলীয় ইশতেহারগুলোতেও উন্নয়ন মানে যেন “বড় কিছু”— “সবচেয়ে উঁচু”, “সবচেয়ে দীর্ঘ”, “সবচেয়ে ব্যয়বহুল” প্রকল্প। কিন্তু বাস্তব উন্নয়ন মানে মানুষের জীবনের মানোন্নয়ন— শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কর্মসংস্থান, নিরাপত্তা ও সামাজিক ন্যায়বিচার।
বিগত সরকারগুলোর মধ্যে এই উপলব্ধির অভাব ছিল প্রকট। উন্নয়নকে তারা রাজনৈতিক প্রচারের উপাদানে রূপ দিয়েছে। “সিঙ্গাপুর বানাবো বাংলাদেশকে”— এমন স্লোগান ছুঁড়ে দেওয়া হয়েছে, কিন্তু কেউ বলেনি, বাংলাদেশকে কীভাবে সত্যিকারের বাংলাদেশি স্বপ্নের দেশ বানানো যায়।
“বাংলাদেশি ড্রিম”: উন্নয়নের নতুন দর্শন
আমাদের প্রয়োজন এমন একটি উন্নয়ন-দর্শন, যা দলমত নির্বিশেষে সাধারণ মানুষের জীবনের সঙ্গে মিশে থাকবে। একে বলা যেতে পারে “বাংলাদেশি ড্রিম”— একটি মানবিক, সমৃদ্ধ, এবং ন্যায়ভিত্তিক বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্ন।
এই স্বপ্ন বাস্তবায়নের জন্য দরকার বাস্তবসম্মত ও গবেষণাভিত্তিক নীতি। রাজনৈতিক দলগুলোর উচিত হবে তাঁদের ইশতেহারে এমন পরিকল্পনা আনা, যা জনজীবনের বাস্তব সমস্যার সমাধান দেয়— যেমন কর্মসংস্থান, ন্যায্য মজুরি, পরিবেশবান্ধব শহর পরিকল্পনা, দুর্নীতিমুক্ত প্রশাসন এবং দক্ষ মানবসম্পদ তৈরি।
বিএনপি বনাম আওয়ামী লীগ: দুই ভিন্ন উন্নয়ন ধারণা
বর্তমানে দেখা যাচ্ছে, আওয়ামী লীগের উন্নয়ন ধারণা এখনো মেগা প্রকল্পনির্ভর। অন্যদিকে, বিএনপি সম্প্রতি যে গবেষণাভিত্তিক পলিসি তৈরির উদ্যোগ নিয়েছে, সেখানে গণমুখী উন্নয়নের ওপর গুরুত্ব দিচ্ছে। দলটির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের বক্তব্যে মেগা প্রকল্প নয়, বরং ‘মানুষকেন্দ্রিক উন্নয়ন’ শব্দটি বারবার উঠে আসছে— যা ইতিবাচক দিক নির্দেশনা।
টেকসই ভবিষ্যতের পথে
বিশ্বের সফল উন্নয়ন মডেলগুলোর দিকে তাকালে দেখা যায়— উন্নয়ন কোনো এককালীন ঘটনা নয়; এটি একটি ক্রমবর্ধমান প্রক্রিয়া। দক্ষিণ কোরিয়া, ভিয়েতনাম, কিংবা ফিনল্যান্ড— তারা উন্নয়ন করেছে মানবসম্পদ ও জ্ঞানের ওপর ভর করে, মেগা সেতু বা টানেল নয়।
বাংলাদেশকেও এখন সেই দিকেই এগোতে হবে। আমাদের উন্নয়ন হবে গণমুখী, জবাবদিহিমূলক ও টেকসই— যেখানে প্রতিটি নাগরিক তার জীবনে পরিবর্তনের স্বাদ পাবে।
উন্নয়ন মানে শুধু দৃশ্যমান প্রকল্প নয়; উন্নয়ন মানে মানুষের মুখে হাসি, কর্মসংস্থানের সুযোগ, এবং দুর্নীতিমুক্ত রাষ্ট্রব্যবস্থা।
সেদিনই বলা যাবে— আমরা উন্নত হচ্ছি, শুধু দেশের চেহারা নয়, দেশের মানুষও বদলাচ্ছে।
