বলিভিয়ার পাহাড়ি জঙ্গলে গুলির শব্দ থেমে গিয়েছিল ১৯৬৭ সালের ৯ অক্টোবর। নিস্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল আর্জেন্টাইন বিপ্লবী আর্নেস্তো “চে” গুয়েভারার রাইফেল। কিন্তু তাঁর স্বপ্ন, তাঁর আদর্শ আর সেই প্রতিরোধের আগুন নিভে যায়নি।
অর্ধশতাব্দীরও বেশি সময় পেরিয়ে গেছে, অথচ আজও সেই আগুন জ্বলছে আন্দিজ পর্বতমালা থেকে গাজার শরণার্থীশিবির পর্যন্ত।
চে-র মৃত্যুর ৫৮ বছর পরও এক প্রশ্ন জেগে থাকে—কীভাবে কিউবার জঙ্গলে লড়া এক আর্জেন্টাইন চিকিৎসক হয়ে উঠলেন ফিলিস্তিনিদের লড়াইয়ের প্রতীক? এই সম্পর্ক কি কেবল প্রতীকী, নাকি চে সত্যিই ছাপ রেখে গেছেন ফিলিস্তিনি প্রতিরোধের চিন্তায়?

🌎 সীমান্তের ওপারে বিপ্লবের ডাক
চে গুয়েভারা চিকিৎসাবিদ্যা ছেড়ে নেমেছিলেন এমন এক অভিযানে, যেটিকে তিনি বলেছিলেন—“অন্যায় থেকে পৃথিবীর আরোগ্য।”
লাতিন আমেরিকা জুড়ে ভ্রমণের সময় তিনি দেখেছিলেন দারিদ্র্য, বৈষম্য ও নিপীড়ন। সেই অভিজ্ঞতা তাঁকে গড়ে তুলেছিল এক বিপ্লবীতে, যিনি পরে কিউবার বাতিস্তা শাসন উৎখাতে মুখ্য ভূমিকা নেন ১৯৫৯ সালে।
কিন্তু কিউবা জয়েই তাঁর পথ থেমে যায়নি। চে বিশ্বাস করতেন, “প্রতিটি সত্যিকারের বিপ্লবই উপনিবেশবাদের বিরুদ্ধে মুক্তির যুদ্ধ।”
তাঁর কাছে বিপ্লব মানে ছিল সীমান্তের ওপারেও ন্যায়ের সংগ্রাম। এই আন্তর্জাতিকতাবাদী দৃষ্টিভঙ্গিই তাঁকে যুক্ত করে দিয়েছিল এক দূর দেশের মানুষের সঙ্গে—ফিলিস্তিনিদের সঙ্গে।
🇵🇸 গাজায় চে-র আগমন
কিউবান বিপ্লবের বিজয়ের কয়েক মাস পর, ১৯৫৯ সালের জুনে চে গুয়েভারা পা রাখেন গাজা উপত্যকায়। তখন গাজা ছিল মিসরের প্রশাসনের অধীনে।
দুই দিনের সেই সফর ইতিহাসে জায়গা করে নেয়।
চে পরিদর্শন করেন আল-বুরেইজ ও আন-নুসেইরাত শরণার্থীশিবির, দেখা করেন ফিলিস্তিনি প্রতিরোধ নেতাদের সঙ্গে, এমনকি কিছু প্রশিক্ষণ শিবিরেও যান।
তাঁর উপস্থিতিতে গাজায় যে উচ্ছ্বাস তৈরি হয়েছিল, তা শুধু রাজনীতি নয়—মানবিকতারও প্রতীক হয়ে উঠেছিল।
তাঁর শরণার্থীশিবিরে তোলা কিছু ছবি ছড়িয়ে পড়ে আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমে। সেই ছবিগুলো ফিলিস্তিনকে তুলে ধরে এক নতুন দৃষ্টিকোণ থেকে—মানবিক সংকট নয়, বরং এক মুক্তির আন্দোলন হিসেবে।
চে-ই প্রথম বিশ্বনেতা, যিনি ফিলিস্তিনের সংগ্রামকে শুধুই মানবিক সহানুভূতির বিষয় হিসেবে না দেখে, এক জাতির স্বাধীনতা যুদ্ধের অংশ হিসেবে দেখেছিলেন।
🔥 আন্দিজ থেকে গাজা: এক অভিন্ন লড়াই
চে-র চোখে কিউবা ও ফিলিস্তিন ছিল একই গল্পের দুই অধ্যায়—একদিকে লাতিন আমেরিকার সাম্রাজ্যবাদবিরোধী সংগ্রাম, অন্যদিকে মধ্যপ্রাচ্যের দখলবিরোধী লড়াই।
এই দৃষ্টিভঙ্গিই পরবর্তী দশকগুলোতে ফিলিস্তিনি আন্দোলনের চিন্তায় ছাপ ফেলে।
ষাট ও সত্তরের দশকে পপুলার ফ্রন্ট ফর দ্য লিবারেশন অব প্যালেস্টাইন (পিএফএলপি) চে-র বিপ্লবী দর্শনকে গ্রহণ করে।
তাঁদের ট্রেনিং ম্যানুয়ালে যোগ হয় ফোকো তত্ত্ব—যে ধারণা চে নিজে কিউবা ও বলিভিয়ায় প্রয়োগ করেছিলেন:
একটি ছোট দলই হতে পারে গণবিপ্লবের স্ফুলিঙ্গ।
লেবাননের কিছু শরণার্থীশিবিরের নামও রাখা হয়—“ক্যাম্প চে গুয়েভারা।”
তাঁর অমর উক্তি—“বিজয় না হওয়া পর্যন্ত লড়াই চালিয়ে যেতে হবে”—ফিলিস্তিনি গোষ্ঠীগুলোর যুদ্ধঘোষণা হয়ে ওঠে।
🎨 গাজার দেয়ালে, মানুষের মনে
আজও গাজার রাস্তায়, ক্যাফেতে, শরণার্থীশিবিরের দেয়ালে টাঙানো আছে চে-র মুখ।
গামাল আবদেল নাসের ও ইয়াসির আরাফাতের পাশে জায়গা পেয়েছেন তিনিও—একজন আর্জেন্টাইন, যিনি তাঁদের মতোই ন্যায়ের জন্য লড়েছিলেন।
নুসেইরাত শরণার্থীশিবিরে রয়েছে “চে গুয়েভারা কালচারাল ক্লাব”—যা নব্বইয়ের দশকে বামপন্থী তরুণেরা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।
এই ক্লাব শুধু চে-র স্মৃতি ধরে রাখে না, বরং আজও তরুণ প্রজন্মকে মনে করিয়ে দেয়—প্রতিরোধের মানে কেবল অস্ত্র নয়, চেতনা।
গাজার খান ইউনিসের এক গ্রাফিতিশিল্পী একবার লিখেছিলেন চে-র প্রতিকৃতির নিচে—
“গুয়েভারা বলিভিয়ায় মারা যাননি… তিনি বেঁচে আছেন প্রতিটি রাস্তায়, যেখানে দখলদারদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ চলছে।”
🌍 “বিপ্লবের কোনো জাতীয়তা নেই”
চে একবার বলেছিলেন—
“যেখানেই অন্যায় থাকবে, তার বিরুদ্ধে লড়াই করা প্রত্যেক মানুষের দায়িত্ব।”
তাঁর এই কথাই যেন গাজার মাটিতে প্রতিধ্বনিত হয় আজও।
যখন রাস্তায় শিশু পাথর ছোড়ে, যখন কোনো তরুণ দেয়ালে প্রতিরোধের প্রতীক আঁকে—তখন মনে হয়, চে গুয়েভারা তাঁদের মধ্যেই আছেন।
সিয়েরা মায়েস্ত্রার পাহাড় থেকে শুরু করে গাজার গলি পর্যন্ত, চে শিখিয়ে গেছেন এক চিরন্তন শিক্ষা—
ন্যায়বিচারের লড়াই কোনো সীমান্ত মানে না, বিপ্লবেরও কোনো পাসপোর্ট লাগে না।
✍️ (রাসেম বিশারাত)
গবেষক ও বিশ্লেষক, পশ্চিম এশিয়া ও লাতিন আমেরিকা বিষয়ক। এই প্রতিবেদনটি অনুপ্রাণিত ইংরেজি লেখাটি প্রথম প্রকাশিত হয় Middle East Monitor-এ।
