“আমি একজন শিক্ষক, আমার অপরাধ— আমি ওর আগে চাকরি পেয়েছি!”
বিছানায় শুয়ে কষ্টভরা কণ্ঠে এ কথাগুলো বললেন বরগুনার স্কুলশিক্ষক রফিকুল ইসলাম। এখন তিনি বরিশালের শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন।
তার অভিযোগ, সহকর্মীর ঈর্ষা ও চাঁদা দাবির কারণে তাঁকে অপহরণ করে রাতভর অমানবিক নির্যাতন চালানো হয়।
নিয়োগের প্রতিযোগিতা, শুরু শত্রুতা
রফিকুল ইসলাম (৩৫) চরকগাছিয়া মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের সহকারী শিক্ষক। তিনি বরগুনা সদর উপজেলার গৌরচন্না ইউনিয়নের ধুপতি গ্রামের ইউনুস আলী মীরের ছেলে।
একই পদের জন্য আবেদন করেছিলেন ওই বিদ্যালয়েরই স্থানীয় বাসিন্দা মিজানুর রহমান, যিনি বর্তমানে আমিনিয়া ফাজিল মাদরাসার প্রভাষক।
বিদ্যালয়ের নিয়োগ পরীক্ষায় রফিকুল নির্বাচিত হন। তখন থেকেই, অভিযোগ অনুযায়ী, ক্ষোভ পুষে রাখেন মিজানুর। স্থানীয়দের ভাষায়— “ওই নিয়োগটাই তাদের শত্রুতার শুরু।”

অপহরণ সেই রাতের
২১ অক্টোবর রাত। বিদ্যালয়ের ছাত্রাবাসে ছিলেন শিক্ষক রফিকুল।
রাত সাড়ে ১০টার দিকে দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ শুনে দরজা খুলতেই সামনে দাঁড়িয়ে মিজানুর ও তার তিন সহযোগী।
তাঁদের হাতে দেশীয় অস্ত্র। হঠাৎ এক আঘাতে টর্চলাইটের আঘাতে রফিকুলের মাথা ফেটে যায়।
এরপর ভয় দেখিয়ে তাঁকে বাইরে নিয়ে যায় দলটি।
মোটরসাইকেলে তুলে নিয়ে যায় দূরের একটি ফলবাগানে— আরপাঙ্গাশিয়া ইউনিয়নের উত্তর যোপখালী গ্রামের এক নির্জন ঘরে।
সেখানে বেঁধে ফেলা হয় দুই হাত। তারপর শুরু হয় চাঁদার দাবি—
“দে ১০ লাখ টাকা, নয়তো প্রাণ যাবে।”
রফিকুল জানান, টাকা দিতে অস্বীকৃতি জানালে তাঁকে লাঠি দিয়ে বেধড়ক পেটানো হয়, গলায় দা ঠেকিয়ে ভয় দেখানো হয়, এবং শেষে জোর করে সোনালী ব্যাংকের এটিএম কার্ড ও পাসওয়ার্ড নিয়ে নেয় তারা।
“আমার কানে এখন শুধু গুঞ্জন শোনা যায়”
হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে রফিকুল বলেন,
“রাতভর তারা আমার গায়ে লাঠি চালিয়েছে। আমি চিৎকার করেছি, কিন্তু কেউ শুনতে পায়নি। নির্যাতনের পরদিন সকালে আমাকে ফেলে চলে যায়। এখন আমার কানে ঠিকভাবে শুনি না— ডাক্তার বলছে, ৬০ শতাংশ শ্রবণশক্তি নষ্ট হয়ে গেছে।”
তিনি আরও জানান, নির্যাতনের সময় তাঁর মোটরসাইকেল, ল্যাপটপ ও এটিএম কার্ডে থাকা প্রায় ৮০ হাজার টাকাও নিয়ে গেছে অভিযুক্তরা।
অভিযোগের তীর মিজানুর রহমানের দিকে
মামলার প্রধান অভিযুক্ত মিজানুর রহমান, চরকগাছিয়া গ্রামের বাসিন্দা। অন্য তিন আসামি হলেন ঘোপখালীর আবুল কালাম আজাদ (নয়া মিয়া), সেলিম ও তালতলীর তোতা মিয়া।
তাঁদের বিরুদ্ধে আমতলী থানায় অপহরণ, চাঁদাবাজি ও নির্যাতনের মামলা করেছেন রফিকুল ইসলাম।
মিজানুর রহমানের মোবাইল নম্বরে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও ফোনটি বন্ধ পাওয়া গেছে।
তবে স্থানীয়রা বলেন, “রফিকুল শান্ত মানুষ, কোনো দ্বন্দ্বে জড়ান না। এমন নির্যাতন অকল্পনীয়।”
স্থানীয়দের ক্ষোভ ও প্রতিবাদ
চরকগাছিয়া এলাকার একাধিক বাসিন্দা বলেন,
“একজন শিক্ষককে অপহরণ করে এমনভাবে নির্যাতন— এটা শুনে পুরো এলাকায় ক্ষোভ। যারা করেছে, তারা যে-ই হোক, তাদের বিচার চাই।”
বিদ্যালয়ের কয়েকজন শিক্ষার্থীও জানান, রফিকুল স্যার খুব নিয়মিত ক্লাস নিতেন, শিক্ষার্থীদের ভালোবাসতেন। তারা এখন আতঙ্কে— “এখন তো আমরাও ভয় পাই, স্যারকে এমন করেছে!”
পুলিশের তদন্ত ও অবস্থান
আমতলী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) দেওয়ান জগলুল হাসান বলেন,
“শিক্ষককে অপহরণ ও নির্যাতনের ঘটনায় মামলা হয়েছে। চারজনকে আসামি করা হয়েছে। আমরা ইতিমধ্যেই অভিযান শুরু করেছি, অভিযুক্তদের গ্রেপ্তারে সর্বোচ্চ চেষ্টা চলছে।”
ওসি আরও জানান, মামলাটি গুরুত্ব দিয়ে দেখা হচ্ছে, কারণ এটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও সমাজের নিরাপত্তা উভয়কেই প্রশ্নবিদ্ধ করছে।
একজন শিক্ষকের ভয় ও বার্তা
হাসপাতালের বেডে বসে শিক্ষক রফিকুল এখন কেবল সুস্থতার অপেক্ষায়। তাঁর ভয়, “যদি আবার আসে!”
তিনি বলেন,
“আমি শুধু শিক্ষকতা করতে চেয়েছিলাম। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে গ্রামের ছাত্রদের ইংরেজি শেখাতে চেয়েছি। আজ আমি শিক্ষক হিসেবে নয়, একজন নির্যাতিত মানুষ হিসেবে হাসপাতালে।”
তবুও তিনি আশা হারাননি—
“আমি বিশ্বাস করি, বিচার পাব। আমি চাই, আর কোনো শিক্ষক যেন এমন নির্যাতনের শিকার না হন।”
শেষ কথা
একজন শিক্ষক— যিনি ছাত্রদের ভাষা শেখানোর দায়িত্বে ছিলেন— এখন নিজের শ্রবণশক্তি হারানোর ভয় নিয়ে বেঁচে আছেন।
একটি চাকরি পাওয়া, একটি পদে যোগদান— সেই প্রতিযোগিতা যদি অপহরণ ও নির্যাতনের কারণ হয়ে ওঠে, তবে প্রশ্ন থেকেই যায়—
আমাদের সমাজে শিক্ষকের মর্যাদা কোথায় দাঁড়িয়ে?
