ইউরোপে অভিবাসন নীতি নিয়ে যখন নতুন করে উত্তাপ ছড়িয়েছে, ঠিক তখনই পর্তুগাল সরকার একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ নিয়েছে। মঙ্গলবার দেশটির সংখ্যালঘু সরকার কট্টর ডানপন্থী দল চেগা (Chega)-র সঙ্গে একটি নতুন চুক্তি স্বাক্ষর করেছে, যার মাধ্যমে বিদেশিদের জন্য পর্তুগিজ নাগরিকত্ব অর্জনের নিয়ম আরও কঠোর করা হবে।
এই সিদ্ধান্তকে কেউ দেখছেন “জাতীয় নিরাপত্তা ও সামাজিক ভারসাম্যের জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ” হিসেবে, আবার অনেকে বলছেন—“মানবিক মূল্যবোধ থেকে বিচ্যুতি ও কট্টর জাতীয়তাবাদের উত্থান।”

🔹 চুক্তির সারাংশ: নাগরিকত্বের পথে কঠিন শর্ত
সরকারের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, নতুন প্রস্তাবিত আইন অনুযায়ী নাগরিকত্ব পাওয়ার জন্য বসবাসের ন্যূনতম সময়সীমা বাড়ানো হবে। বর্তমানে যে সময়সীমা ৫ বছর, সেটি বাড়িয়ে ৮ থেকে ১০ বছর পর্যন্ত করা হতে পারে বলে ইঙ্গিত দিয়েছে পার্লামেন্টের ক্ষমতাসীন জোটের প্রধান হুগো সোয়ারেস।
তিনি বলেন,
“আমাদের দেশের ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে নাগরিকত্বের মানের ওপর। আমরা চাই, যারা এখানে নাগরিকত্ব পাবে, তারা সত্যিকার অর্থে পর্তুগালের সংস্কৃতি, ভাষা ও মূল্যবোধ বুঝে নিজেদের এই সমাজের অংশ হিসেবে গড়ে তুলুক।”
এই পরিবর্তনের ফলে ইউরোপীয় ইউনিয়নের বাইরে থেকে আগত অনেক অভিবাসী, বিশেষ করে দক্ষিণ এশিয়া, আফ্রিকা ও ব্রাজিল থেকে আসা শ্রমিকরা নাগরিকত্ব পাওয়ার ক্ষেত্রে নতুন জটিলতার মুখে পড়বেন বলে ধারণা করা হচ্ছে।
🔹 চেগার উত্থান: অভিবাসনবিরোধী রাজনীতির সাফল্য
চুক্তির অন্যতম পক্ষ চেগা (Chega)—পর্তুগিজ ভাষায় যার অর্থ “Enough” বা “যথেষ্ট”—গত কয়েক বছরে অভিবাসনবিরোধী নীতি ও কঠোর আইন-শৃঙ্খলা দাবির মধ্য দিয়ে জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে।
দলের নেতা আন্দ্রে ভেন্তুরা এই চুক্তিকে “ঐতিহাসিক মুহূর্ত” হিসেবে অভিহিত করে বলেন,
“আজ পর্তুগাল যোগ দিল সেই ইউরোপীয় দেশগুলোর সারিতে, যেখানে নাগরিকত্ব আর সহজলভ্য নয়। আমরা আমাদের সংস্কৃতি ও ভবিষ্যৎ রক্ষার প্রথম পদক্ষেপ নিয়েছি।”
তবে তিনি এটিও স্বীকার করেছেন যে,
“এই চুক্তিতে উভয় পক্ষই আপস করেছে। আমাদের লক্ষ্য ছিল অভিবাসন পুরোপুরি বন্ধ করা নয়, বরং নিয়ন্ত্রিত ও দায়িত্বশীল অভিবাসন নিশ্চিত করা।”
চেগা বর্তমানে পর্তুগিজ পার্লামেন্টে তৃতীয় বৃহত্তম দল, এবং গত বছরের নির্বাচনে তারা প্রথমবারের মতো প্রধান বিরোধী দল হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। এই উত্থান ইউরোপে ডানপন্থী জাতীয়তাবাদের পুনরুজ্জীবনের অংশ বলেই বিশ্লেষকরা মনে করছেন।
🔹 সরকারের দুর্বল সংখ্যাগরিষ্ঠতা ও রাজনৈতিক হিসাব
গত মে মাসের নির্বাচনে মধ্য-ডানপন্থী নেতা লুইস মন্টেগ্রো নেতৃত্বাধীন জোট সরকার ক্ষমতায় এলেও তারা সংসদে পূর্ণ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করতে পারেনি। ফলে, সরকারকে নীতি বাস্তবায়নে চেগা বা অন্যান্য দলগুলোর সমর্থন নিতে হচ্ছে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, এই নাগরিকত্ব আইন সেই সমর্থন পাওয়ারই একটি কৌশল।
লিসবন বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনীতি বিশ্লেষক মার্তা লোপেজ বলেন,
“মন্টেগ্রো সরকার জানে, অভিবাসন নিয়ে জনগণের মধ্যে আশঙ্কা বাড়ছে। চেগার সঙ্গে এই চুক্তি সরকারের টিকে থাকার কৌশল হিসেবেও দেখা যেতে পারে।”
তবে তিনি সতর্ক করেন,
“যদি নীতিগুলো অত্যন্ত কঠোর হয়, তাহলে এটি মানবাধিকার ও আন্তর্জাতিক চুক্তির সঙ্গে সাংঘর্ষিক হতে পারে।”
🔹 অভিবাসনের বাস্তবতা: দ্রুত বেড়ে চলা সংখ্যা
পর্তুগালের সরকারি পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০২৪ সালের শেষে দেশটিতে প্রায় ১৫ লাখ বিদেশি নাগরিক বসবাস করছেন—যা ২০১৭ সালের তুলনায় প্রায় চারগুণ বেশি।
দেশটির মোট জনসংখ্যার প্রায় ১৫ শতাংশই এখন অভিবাসী। এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য অংশ এসেছে ব্রাজিল, ভারত, বাংলাদেশ, নেপাল, আফ্রিকা এবং পূর্ব ইউরোপীয় দেশগুলো থেকে।
তারা মূলত নির্মাণ, কৃষি, হোটেল-রেস্টুরেন্ট ও পরিষেবা খাতে কাজ করেন।
তবে চেগা এবং অন্যান্য ডানপন্থী গোষ্ঠীগুলোর অভিযোগ—“অভিবাসীরা দেশটির সামাজিক সেবা ব্যবস্থার ওপর অতিরিক্ত চাপ সৃষ্টি করছে।”
অন্যদিকে মানবাধিকার সংগঠনগুলো বলছে,
“অভিবাসীরাই পর্তুগালের অর্থনীতিকে সচল রেখেছে। তারা ট্যাক্স দেয়, কাজ করে, অথচ এখন তাদের ওপরই নাগরিকত্বের দরজা বন্ধ করা হচ্ছে।”
🔹 ইউরোপে অভিবাসনবিরোধী স্রোত
পর্তুগালের এই সিদ্ধান্ত ইউরোপের চলমান রাজনৈতিক প্রবণতারই প্রতিফলন।
ইতালি, ফ্রান্স, নেদারল্যান্ডস ও জার্মানির মতো দেশগুলোতেও সাম্প্রতিক বছরগুলোতে অভিবাসনবিরোধী দলগুলোর উত্থান দেখা যাচ্ছে।
২০২৫ সালের ইউরোপীয় পার্লামেন্ট নির্বাচনকে সামনে রেখে অনেক সরকার অভিবাসন নিয়ে কড়া অবস্থান নিচ্ছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন,
“পর্তুগাল ঐতিহাসিকভাবে মানবিক মূল্যবোধের দেশ হলেও, ইউরোপীয় রাজনীতির পরিবর্তন সেখানে প্রভাব ফেলছে।”
🔹 অভিবাসীদের উদ্বেগ ও মানবাধিকার কর্মীদের প্রতিক্রিয়া
লিসবনের বিভিন্ন অভিবাসী সংগঠন ইতিমধ্যেই এই আইন নিয়ে তীব্র উদ্বেগ প্রকাশ করেছে।
বাংলাদেশি কমিউনিটি অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি রফিকুল ইসলাম বলেন,
“আমরা এখানে বছরের পর বছর ধরে বৈধভাবে কাজ করছি, কর দিচ্ছি, কিন্তু এখন যদি নাগরিকত্বের নিয়ম কঠিন করা হয়, তাহলে আমাদের ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত হয়ে যাবে।”
মানবাধিকার সংস্থা অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল এক বিবৃতিতে জানিয়েছে—
“এই পদক্ষেপ পর্তুগালের আন্তর্জাতিক প্রতিশ্রুতির পরিপন্থী। সরকার যদি নাগরিকত্ব পাওয়ার পথ জটিল করে তোলে, তাহলে সেটি সরাসরি বৈষম্যের শামিল হবে।”
🔹 আইনের পরবর্তী ধাপ: পার্লামেন্টে ভোট
চুক্তি স্বাক্ষরের পর মঙ্গলবার পর্তুগিজ পার্লামেন্টে প্রস্তাবিত আইনটি নিয়ে প্রথম দফা ভোট অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা।
এতে যদি প্রাথমিক অনুমোদন পায়, তাহলে আইনটি বিশদ পর্যালোচনার জন্য সংসদীয় কমিটিতে পাঠানো হবে।
সরকার আশা করছে, আগামী বছরের শুরুতেই আইনটি কার্যকর করা যাবে।
তবে সংসদে বিরোধীদল ও মানবাধিকারপন্থী গোষ্ঠীগুলোর প্রবল বিরোধিতার মুখে সংশোধনীর দাবি উঠতে পারে।
🔹 সম্ভাব্য প্রভাব ও ভবিষ্যতের চিত্র
এই আইন কার্যকর হলে, হাজার হাজার অভিবাসী নাগরিকত্বের আবেদন দিতে আরও দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করতে হবে।
এতে শুধু বিদেশিরাই নয়, পর্তুগালের শ্রমবাজারও প্রভাবিত হতে পারে, কারণ নির্মাণ ও কৃষি খাতে স্থানীয় শ্রমিকের ঘাটতি রয়েছে।
অর্থনীতিবিদরা সতর্ক করেছেন—
“অতিরিক্ত কঠোর নীতি বিনিয়োগে প্রভাব ফেলবে এবং শ্রমঘাটতির কারণে উন্নয়ন প্রকল্পে ধীরগতি আসতে পারে।”
🌍 উপসংহার: পরিবর্তনের দ্বারপ্রান্তে পর্তুগাল
পর্তুগাল দীর্ঘদিন ধরেই ইউরোপের সবচেয়ে “ওপেন” ও সহনশীল দেশ হিসেবে পরিচিত ছিল।
কিন্তু আজ সেই দেশও ইউরোপীয় অভিবাসন রাজনীতির ঢেউয়ে ভেসে যাচ্ছে।
এই চুক্তি একদিকে সরকারের রাজনৈতিক টিকে থাকার কৌশল, অন্যদিকে ইউরোপে ডানপন্থী শক্তির উত্থানের স্পষ্ট প্রতিচ্ছবি।
তবে প্রশ্ন একটাই থেকে যায়—
“নাগরিকত্ব কঠিন করে কি সত্যিই রাষ্ট্রের নিরাপত্তা বাড়ে, নাকি এতে মানবিকতার মূল ভিত্তিই ক্ষয়ে যায়?”
এই উত্তর হয়তো সময়ই দেবে, তবে আপাতত পর্তুগাল দাঁড়িয়ে আছে এক নতুন রাজনৈতিক বাস্তবতার সম্মুখে—
যেখানে বুদ্ধি ও নীতি নয়, বরং ভয় ও জাতীয়তাবাদ হয়ে উঠছে আইন তৈরির চালিকাশক্তি।
📌 সূত্র: রয়টার্স, বিবিসি, এল পাইস, পর্তুগিজ সংসদীয় নথি (অক্টোবর ২০২৫)
