কোরআনুল কারিমের অনুবাদ ও সংক্ষিপ্ত ব্যাখ্যা
সুরা : আনআম | আয়াত : ১০৫
ধর্ম ডেস্ক | ঢাকা
🌿 بِسْمِ اللّٰهِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِیْمِ
পরম করুণাময়, অসীম দয়ালু আল্লাহর নামে
وَ كَذٰلِكَ نُصَرِّفُ الۡاٰیٰتِ وَ لِیَقُوۡلُوۡا دَرَسۡتَ وَ لِنُبَیِّنَهٗ لِقَوۡمٍ یَّعۡلَمُوۡنَ (১০৫)
সরল অনুবাদ:
“এভাবেই আমি বিভিন্ন প্রকারে নিদর্শনসমূহ বিশদভাবে বর্ণনা করি, যাতে অবিশ্বাসীরা বলে—‘তুমি তো পূর্ববর্তী কিতাবগুলো অধ্যয়ন করে বলছ!’ এবং যাতে আমি তা জ্ঞানী সম্প্রদায়ের জন্য সুস্পষ্টভাবে ব্যাখ্যা করি।”

🌙 আয়াতের প্রেক্ষাপট
সুরা আনআমের এই আয়াতটি নাজিল হয় এমন এক সময়ে, যখন অবিশ্বাসীরা রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর প্রচারিত সত্যবাণীকে মিথ্যা প্রমাণ করতে মরিয়া হয়ে উঠেছিল।
তারা বলত—“এই বাণী নিশ্চয়ই কোনো মানুষ তাঁকে শিখিয়েছে।” অথচ, মহানবী (সা.) ছিলেন উম্মি (নিরক্ষর), যিনি কখনো কোনো বই পড়েননি, কারো কাছে শিক্ষা নেননি।
তবুও কোরআনের প্রতিটি আয়াতে এমন জ্ঞান, যুক্তি ও ভাষার গভীরতা প্রকাশ পেয়েছে, যা মানব সভ্যতার সব দার্শনিক ও সাহিত্যিক মিলে সৃষ্টি করতে অক্ষম।
🕋 বুদ্ধিমানদের জন্য পথপ্রদর্শক
আয়াতের শেষাংশে আল্লাহ তাআলা বলেন—
“…এবং যাতে আমি তা জ্ঞানী সম্প্রদায়ের জন্য সুস্পষ্টভাবে ব্যাখ্যা করি।”
এখানে “জ্ঞানী সম্প্রদায়” বলতে বোঝানো হয়েছে সেইসব মানুষকে, যাদের অন্তর খোলা, যারা সত্য খোঁজে, যারা চিন্তা করে।
তারা কোরআনের আয়াতগুলো পড়লে তাতে আলোর দিকনির্দেশনা খুঁজে পায়।
আল্লাহর এই আলোকিত বাণী তাদের হৃদয়ে হেদায়াতের জ্যোতি জ্বালিয়ে দেয়, যেমন আল্লাহ বলেন—
“যাকে আল্লাহ হেদায়াত দেন, তাকে কেউ ভ্রান্ত করতে পারে না।” (সুরা জুমার, ৩৬)
🔥 কুটিল হৃদয়ের পরিণতি
অন্যদিকে, যারা নিজেদের কুটিল চিন্তা, অহংকার ও অবিশ্বাসে অন্ধ, তাদের জন্য একই আয়াত হয়ে ওঠে বিভ্রান্তির কারণ।
তারা সত্যের আলো দেখতে পেলেও সেটিকে অস্বীকার করে।
তাদের অন্তর যেন আয়নার মতো ছিল, কিন্তু অবাধ্যতার কারণে তাতে জমেছে পাপের কালো স্তর। ফলে, আলো এসে পড়ে, কিন্তু প্রতিফলিত হয় না।
কোরআনের আরেক আয়াতে বলা হয়েছে—
“তাদের অন্তর তালাবদ্ধ; তাই তারা বোঝে না।” (সুরা তওবা, ৮৭)
🌸 মহানবী (সা.)–এর প্রতি অবিশ্বাসীদের অপবাদ
আয়াতে বলা হয়েছে, কাফিররা বলত,
“তুমি নিশ্চয়ই অন্য কিতাব পড়ে এসব বলছ।”
অর্থাৎ, তারা ভাবত, রাসুলুল্লাহ (সা.) কারো কাছ থেকে শিখে এই বাণী প্রচার করছেন।
কিন্তু ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়—মহানবী (সা.) কখনো কোনো শিক্ষকের শরণাপন্ন হননি, কোনো কিতাব পাঠ করেননি।
তবুও তাঁর মুখ দিয়ে এমন তাওহিদের বার্তা, এমন দার্শনিক গভীরতা, এমন ভাষার সৌন্দর্য ফুটে উঠেছে—যা আজও বিশ্ববিজ্ঞান, সাহিত্য ও মানবসভ্যতার গবেষণার বিষয়।
এ কারণেই অনেক মুফাসসির বলেছেন—
“একজন নিরক্ষর ব্যক্তির মুখে এমন জ্ঞানের প্রকাশই প্রমাণ করে, এটি কোনো মানুষের বাণী নয়, বরং আল্লাহর বাণী।” (ফাতহুল কাদীর)
🌼 আয়াতের মূল শিক্ষা
এই আয়াতের সারকথা হলো —
- কোরআন আল্লাহর পক্ষ থেকে এক নিখুঁত জ্ঞানের ভান্ডার।
- জ্ঞানী ও বুদ্ধিমানরা এটিতে খুঁজে পায় সত্যের আলো।
- কিন্তু অহংকারী ও কুটিলরা একই আলো থেকে হারিয়ে ফেলে দিকনির্দেশনা।
- রাসুলুল্লাহ (সা.)–এর কাজ হলো শুধু আল্লাহর বাণী পৌঁছে দেওয়া, কে মানল আর কে মানল না — সেটি আল্লাহর বিচার্য বিষয়।
🌙 আজকের যুগে প্রাসঙ্গিকতা
এই আয়াত আজও আমাদের জন্য শিক্ষা রেখে গেছে।
আজও কেউ কেউ ধর্মের আলোকে উপেক্ষা করে যুক্তিহীন মতবাদে বিশ্বাস করে, আবার কেউ কোরআনের আলোতে খুঁজে পায় জীবনের মানে ও শান্তি।
আল্লাহ তাআলা বলেন—
“এই কোরআন এমন এক দিশারি, যার মাধ্যমে আল্লাহ সৎপথে পরিচালনা করেন তাঁদের, যারা তাঁর সন্তুষ্টি কামনা করে।” (সুরা মায়িদা, ১৬)
🌺 উপসংহার
সত্যের আলো সবার সামনে উন্মুক্ত।
কিন্তু হৃদয়ের জানালা বন্ধ থাকলে সেই আলো পৌঁছায় না।
এই আয়াত আমাদের শেখায় — যারা জ্ঞান, বোধ ও বিনয় নিয়ে কোরআনের দিকে এগোয়, তারাই হেদায়াতের আলো পায়।
আর যারা কুটিলতা ও অহংকারে অন্ধ, তাদের জন্য সেই একই আলো হয়ে ওঠে বিভ্রান্তির কারণ।
📖 সূত্র:
- তাফসির ফাতহুল কাদীর
- আত-তাফসিরুল মুয়াসসার
- সুরা আনআম, আয়াত : ১০৫
