শীতের শুরুতেই আবারও বিষধোঁয়ায় ঢেকে গেছে ভারতের রাজধানী নয়াদিল্লি। বাতাসে দম বন্ধ করা দূষণ, আকাশে ঝুলছে ধোঁয়ার আস্তরণ, দৃশ্যমানতা কমে এসেছে অর্ধেকে। পরিস্থিতি এতটাই ভয়াবহ যে শেষ পর্যন্ত রাজধানীর আকাশে বৃষ্টি নামাতে হয়েছে কৃত্রিমভাবে।
আজ মঙ্গলবার দুপুরে দিল্লির বিস্তীর্ণ এলাকায় দফায় দফায় ‘ক্লাউড সিডিং’ বা কৃত্রিম মেঘ বোনা হয়েছে। এখন অপেক্ষা—আকাশ থেকে নামুক সেই কাঙ্ক্ষিত বৃষ্টি, যাতে ধুয়ে যায় রাজধানীর ঘন ধোঁয়া আর বিষাক্ত বাতাস।

🔹 আইআইটি কানপুরের উদ্যোগে কৃত্রিম বৃষ্টি
দিল্লির এই “আবহাওয়ার চিকিৎসা” প্রকল্পের দায়িত্ব পেয়েছে উত্তর প্রদেশের আইআইটি কানপুর। সংস্থার বিশেষজ্ঞ দল আজ দুপুরে কানপুর থেকে উড়ে আসে একটি বিশেষভাবে ডিজাইন করা সেসনা উড়োজাহাজে।
বিমানটি দিল্লির বুরারি, উত্তর করোলবাগ, ময়ুর বিহার, ভোজপুর ও সড়কপুর এলাকার আকাশে উড়ে উড়ে সিলভার আয়োডাইড ও সোডিয়াম ক্লোরাইড—এর মতো রাসায়নিক মিশিয়েছে মেঘের মধ্যে।
এই রাসায়নিক পদার্থ মেঘে ঘনীভবনের প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত করে, ফলে মেঘের কণাগুলো বড় হয়ে বৃষ্টিকণায় পরিণত হয়। প্রকল্পের উদ্দেশ্য—দূষণ কমিয়ে অন্তত স্বল্পমেয়াদি শ্বাস নেওয়ার স্বস্তি ফিরিয়ে আনা।
দিল্লির পরিবেশমন্ত্রী মনজিন্দর সিং সিরসা জানান,
“এমনকি অল্প পরিমাণ কৃত্রিম বৃষ্টি হলেও তা বাতাসের দূষণমাত্রা উল্লেখযোগ্যভাবে কমাতে পারে। পর্যায়ক্রমে তিন-চারবার ক্লাউড সিডিংয়ের পরিকল্পনা আছে।”
🔹 দূষণ কমাতে ব্যর্থ বাজি ও খড় পোড়ানো বন্ধে ব্যর্থতা
দিল্লির দূষণ যে বারবার নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে, তার পেছনে মূলত দুটি বড় কারণ—দীপাবলির বাজি পোড়ানো ও পাঞ্জাব–হরিয়ানা অঞ্চলে ফসলের গোড়া পোড়ানো (স্টাবল বার্নিং)।
কেন্দ্র ও রাজ্য সরকার, এমনকি আদালতের নির্দেশও এবার কার্যকর হয়নি। দীপাবলির সময় “গ্রিন ক্র্যাকার” বা দূষণমুক্ত বাজি পোড়ানোর অনুমতি দেওয়া হলেও বাস্তবে দিল্লি ও আশপাশের এলাকায় বিপুল পরিমাণ দূষণযুক্ত বাজিই ব্যবহৃত হয়েছে।
সুপ্রিম কোর্টও শেষ পর্যন্ত ধর্মীয় সংবেদনশীলতার যুক্তিতে কঠোর অবস্থান নিতে পারেনি। বিজেপি ও হিন্দুত্ববাদী সংগঠনগুলোর দাবি ছিল—“দীপাবলিতে বাজি পোড়ানো নিষিদ্ধ করা মানে সনাতন ধর্মের বিরোধিতা।”
ফলে, দীপাবলির পরদিন থেকেই রাজধানীর আকাশে ধোঁয়া জমতে শুরু করে। সেই সঙ্গে যুক্ত হয় কৃষিক্ষেতের খড় পোড়ানোর ধোঁয়া—ফলে একিউআই (AQI) মাত্রা ছুঁয়েছে “বিপজ্জনক” পর্যায়।
🔹 কাজে নামল প্রযুক্তি, বাজেট ৩ কোটি রুপি
দিল্লি সরকার এই কৃত্রিম বৃষ্টির জন্য আইআইটি কানপুরকে দিয়েছে ৩ কোটি ২১ লাখ রুপির বাজেট।
বিশেষজ্ঞদের মতে, ক্লাউড সিডিংয়ের পর ১৫ থেকে ৩০ মিনিটের মধ্যেই বৃষ্টি শুরু হতে পারে, যদি আবহাওয়া অনুকূলে থাকে। তবে ঠান্ডা ও শুষ্ক মেঘের ক্ষেত্রে বৃষ্টি হতে সময় লাগতে পারে দুই ঘণ্টা পর্যন্ত।
যদি বাতাসের বেগ বেশি হয়, আর্দ্রতা ২০ শতাংশের নিচে নামে বা মেঘের গঠন দুর্বল হয়, তবে বৃষ্টি নাও হতে পারে।
তবুও আশাবাদী দিল্লির কর্তৃপক্ষ। কারণ, প্রাকৃতিক বৃষ্টি না হলেও রাসায়নিকভাবে সৃষ্ট সামান্য বৃষ্টিপাতও বাতাসের ধুলিকণা ও কার্বন কণাকে নিচে নামাতে সাহায্য করবে।
🔹 রাজনৈতিক ও পরিবেশগত প্রতিক্রিয়া
রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা বলছেন, দিল্লির নতুন বিজেপি সরকার এবারও দূষণ নিয়ন্ত্রণে তেমন সাফল্য দেখাতে পারেনি।
দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশবিজ্ঞান অধ্যাপক অমিতাভ রায় বলেন,
“ক্লাউড সিডিং আসলে একটি ‘ইমার্জেন্সি মেজার’। এটি মূল সমস্যার সমাধান নয়। যতক্ষণ পর্যন্ত বাজি, যানবাহনের ধোঁয়া ও কৃষিক্ষেতের আগুন বন্ধ না হয়, ততক্ষণ দিল্লি বিষমুক্ত হবে না।”
তবে সাধারণ মানুষ আশা হারায়নি। অনেকেই বলছেন, “যে কোনোভাবে একটু বৃষ্টি হোক, অন্তত কয়েকদিনের জন্য শ্বাস নেওয়া সহজ হোক।”
🔹 আকাশে আশা, মাটিতে উৎকণ্ঠা
মঙ্গলবার সকাল থেকেই দিল্লির আকাশ ছিল ধোঁয়ায় ঢাকা। কেন্দ্রীয় দূষণ নিয়ন্ত্রণ বোর্ডের (CPCB) তথ্য অনুযায়ী, রাজধানীর ৩৮টি পর্যবেক্ষণ কেন্দ্রের মধ্যে ২৭টিতেই AQI “সেভিয়ার” বা “অত্যন্ত বিপজ্জনক” পর্যায়ে পৌঁছেছে।
এই পরিস্থিতিতে, আকাশে বোনা কৃত্রিম মেঘ এখন দিল্লিবাসীর একমাত্র আশার প্রতীক।
তবে বৃষ্টি নেমে দূষণ কতটা কমবে, সেটি জানার জন্য অপেক্ষা আর কয়েক ঘণ্টা।
🌧️ উপসংহার: কৃত্রিম বৃষ্টি—নাকি কৃত্রিম স্বস্তি?
দিল্লির এই উদ্যোগ একদিকে প্রযুক্তির সাফল্য, অন্যদিকে ব্যর্থ নগর পরিকল্পনার প্রতীকও বটে।
প্রতিবারই দীপাবলি ও ফসল পোড়ানোর মৌসুমে সরকার প্রতিশ্রুতি দেয়, “এবার দূষণ কমবে”—
কিন্তু বাস্তবে তার প্রমাণ মেলে না।
এবারও প্রশ্নটা একই—
কৃত্রিম মেঘে বৃষ্টি নামলেও, মানুষের আচরণে যে দূষণের মেঘ জমেছে, তা কে সরাবে?
📸 ছবি: এএনআই, সূত্র: টাইমস অব ইন্ডিয়া, এনডিটিভি, সিবিসি নিউজ, আইআইটি কানপুর প্রেস ব্রিফ (অক্টোবর ২০২৫)
